ভূমিকম্পে করণীয়: সচেতনতা, প্রস্তুতি ও নিরাপত্তার সমন্বিত নির্দেশনা-আবুল কালাম আজাদ

ভূমিকম্প একটি আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থান করায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পে অধিকাংশ প্রাণহানি ঘটে আতঙ্ক, দুর্বল ভবন এবং ভারী বস্তু পতনের কারণে—যা সঠিক জ্ঞান ও প্রস্তুতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
১. ভূমিকম্পের আগে করণীয়: নিরাপত্তার ভিত্তি গড়ে তোলা
ক. বাড়ির কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ দেয়াল, সিলিং, বিম বা কলামে ফাটল থাকলে দ্রুত মেরামত করুন।
বড় আলমারি, বুকশেলফ, ফ্রিজ এবং অন্যান্য ভারী ফার্নিচার দেয়ালে স্থিরভাবে লাগিয়ে দিন।
যুক্তি: ভূমিকম্পে অধিকাংশ আঘাত ভারী বস্তুর পতনেই ঘটে।
খ. জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা, টর্চলাইট, ফার্স্ট এইড বক্স, ব্যাটারি, প্রয়োজনীয় ওষুধ, পানি ও শুকনো খাবার সবসময় হাতের কাছে রাখুন।
যুক্তি: কম্পন থামার পরপরই নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে এটি দ্রুত সহায়তা করে।
গ. পারিবারিক সচেতনতা ও মহড়া,পরিবারকে নিরাপদ জায়গা, বের হওয়ার পথ, এবং কীভাবে টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে হয় এসব শিখিয়ে দিন।
যুক্তি: গবেষণা বলছে, পারিবারিক ড্রিল জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা ৫০% পর্যন্ত বাড়ায়।
২. ভূমিকম্পের সময় করণীয়: আতঙ্কের পরিবর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত
ক. ঘরের ভিতরে থাকলে “ডাক–কভার–হোল্ড” পদ্ধতি অনুসরণ করুন মজবুত টেবিল/ডেস্কের নিচে ঢুকে পড়ুন।
হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন।টেবিল/ফার্নিচার শক্ত করে ধরে রাখুন।
যুক্তি: এটি আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত।
খ. জানালা, দরজা ও ঝুলন্ত বস্তু থেকে দূরে থাকুন
গ্লাস ভেঙে উড়ে আসতে পারে এবং দুর্বল দরজা ফ্রেম ধসে যেতে পারে।
গ. লিফট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন
কম্পনের সময় লিফট আটকে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
ঘ. বাইরে থাকলে, খোলা জায়গায় দাঁড়ান। ভবন, গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং টাওয়ার থেকে দূরে সরে যান।
ঙ. গাড়িতে থাকলে
গাড়ি থামিয়ে নিরাপদ খোলা জায়গায় অপেক্ষা করুন।
ব্রিজ বা বিল্ডিংয়ের নিচে গাড়ি থামাবেন না।
৩. ভূমিকম্পের পর করণীয়: নিরাপত্তা ও উদ্ধারসমন্বয়
ক. নিজের ও পরিবারের আঘাত পর্যালোচনা প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করুন। গুরুতর আহতদের সরানোর সময় সতর্ক থাকুন।
খ. গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন পরীক্ষা ফাঁস বা শর্ট সার্কিট দেখা গেলে অবিলম্বে বন্ধ করুন।
যুক্তি: ভূমিকম্প-পরবর্তী সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে।
গ. ভবনে ক্ষতি দেখা দিলে ভেতরে প্রবেশ করবেন না
কারণ আফটারশক বা দ্বিতীয় ধাক্কা বড়সড় ধস সৃষ্টি করতে পারে।
ঘ. আটকে পড়া ব্যক্তিদের সহায়তা
শব্দ শুনে কর্তৃপক্ষকে জানান। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া ধ্বংসস্তূপে প্রবেশ করবেন না।
ঙ. সঠিক তথ্য গ্রহণ করুন, রেডিও, টেলিভিশন, সরকারি পেজ ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
গুজব ছড়ানো বা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকুন।
৪. কেন প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি?
বাংলাদেশ সক্রিয় ভূ-তাত্ত্বিক প্লেটের ওপর অবস্থান করায় বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবসময় থাকে।
নগর অঞ্চলের অধিকাংশ ভবন এখনো আন্তর্জাতিক মানে নির্মিত নয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা ও প্রস্তুতি জীবনরক্ষার সম্ভাবনা ৩ গুণ বাড়ায়।
আতঙ্কজনিত দৌড়াদৌড়ি ও ভারী বস্তুর পতনে মোট হতাহতের ৩০-৪০% ঘটে যা পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব।
সচেতনতা, সঠিক সিদ্ধান্ত ও পূর্বপ্রস্তুতি এই তিনটি বিষয় ভূমিকম্পে জীবনরক্ষার সবচেয়ে নিশ্চিত পথ।
(লেখক: সাধারণ সম্পাদক, আমরা পল্লবী বাসী, ঢাকা)






















